চেক ডিজঅনার ও আইনী প্রতিকার
আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে চেক একটি নিরাপদ মাধ্যম। ব্যাংক থেকে ঋন অথবা কোন ব্যক্তির নিকট থেকে টাকা ধার হিসেবে গ্রহণ করলেও জামানত হিসেবে চেক ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে বর্তমান সময়ে চেক জালিয়াতি, চেক চুরি ও চেক বাউন্সের মামলা অধিকভাবে বেড়েছে।
চেক বাউন্স বা ডিজঅনার হলে মামলা দায়ের করতে হয় ১৮৮১ সালের হস্তান্তর যোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারা মোতাবেক। উক্ত ধারায় দোষী সাব্যস্ত হলে আদালত সর্বোচ্চ ১ (এক) বছরের কারাদন্ড এবং চেকে উল্লখিত অর্থের ৩ (তিন) গুন সমপরিমান অর্থ জরিমানা করতে পারে। উক্ত ধারার মামলাটি জামিনযোগ্য, অ-আমলযোগ্য ও আপোষযোগ্য।
চেক ডিজঅনারের মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া
যে চেক সংক্রান্ত মামলা দায়ের করা হবে সেটি অবশ্যই চেকে উল্লেখিত তারিখ হতে ৬ (ছয় ) মাসের মধ্যে ব্যাংক কর্তৃক অপর্যাপ্ত তহবিল থাকার কারনে ডিজঅনার হতে হবে।
ব্যাংক হিসাবটি বন্ধ করা হয়েছে বা চেকটি সঠিকভাবে এন্ডরসমেন্ট না হওয়ার কারণে প্রত্যাখান করা হলেও মামলা করা যাবে। চেকটি ব্যাংক কর্তৃক ফেরত প্রদানের ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে একাউন্ট হোল্ডারের নিকট চেকে উল্লেখিত অর্থ দাবি করে রেজিস্টার্ড ডাক যোগে এ/ডি সংবলিত নোটিশ প্রদান করতে হয়। নোটিশটি আইনজীবীর মাধ্যমেও প্রেরন করা যেতে পারে।
নোটিশে অবশ্যই টাকা প্রদানের জন্য নোটিশ গ্রহণের তারিখ দিন থেকে ৩০ (ত্রিশ) দিন সময় প্রদান করতে হবে। এর আগে মামলা দায়েরের সুযোগ নেই। নোটিশ গ্রহণের ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে অর্থ ফেরত প্রদান করা না হলে এর পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে হয়।
মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অবশ্যই মূল চেক, ডিজনার স্লিপ ও লিগ্যাল নোটিশ আদালতে দাখিল করতে হবে।
চেক জালিয়াতি করে মামলা দায়ের করা হলে কি প্রতিকার রয়েছে?
যদি চেক হারিয়ে গিয়ে থাকে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি বা সাধারন ডায়েরি দায়ের করতে হবে এবং ব্যাংককে অবগত করে একাউন্টিতে লেনদেন স্থগিত করতে হবে। যদি চেকটি কোন ব্যক্তির নিকট দখলে রয়েছে এ সংক্রান্ত তথ্য থাকে সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৮ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দরখাস্ত দাখিল পূর্বক চেকটি যে স্থানে রয়েছে সে জায়গা থেকে উদ্ধারের জন্য তল্লাশি পরোওয়ানা বা সার্চ ওয়ারেন্ট জারি করা যেতে পারে।
কোন ব্যক্তি যদি তার কাছে প্রদত্ত ব্লাঙ্ক চেক জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজন পূর্বক প্রতারনার উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করে সে ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী অবশ্যই দন্ডবিধি আইনে প্রতারনা এবং উক্ত আইনের ৪৬৫ ধারায় জালিয়াতির মামলা দায়ের করতে পারে। এমনকি চেকের স্বাক্ষর যাচাই করনের জন্য হস্তরেখা বিশেষজ্ঞের নিকট পাঠানোর জন্য আদালতে প্রার্থনা করা যায়।
যদি হয়রানি বা প্রতারনা মূলক উদ্দেশ্যে চেকের মামলা হয়ে থাকে, অবশ্যই আসামীর আইনজীবীকে বাদী ও অন্যান্য সাক্ষীদেরকে দক্ষতার সাথে জেরা করতে হয়। জেরায় সত্য উদঘাটিত হলে আসামীর খালাস পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এছাড়াও চেক ডিজঅনারের মামলা খারিজ বা কোয়াসমেন্ট এর জন্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১এ এর ধারা মোতাবেক আবেদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে মামলার প্রসিডিংস-এ আইনগত কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে আদালত তার সহজাত ক্ষমতায় মামলাটি স্থগিত ও শুনানি অন্তে খারিজ করতে পারে।
চেক বাউন্সের মামলায় সাজা হলে কি করণীয়?
চেক ডিজঅনারের মামলায় সাজা হলে, দণ্ডিত ব্যক্তির উচ্চ আদালতে আপিল দায়েরের সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই চেকে উল্লেখিত অর্থের অর্ধেক টাকা (৫০%) আদালতে ব্যাংক চালানের মাধ্যমে দাখিল করেত হয়। তবে আদালত বিশেষ বিবেচনায় ৫০% শতাংশ অর্থ কিস্তিতে পরিশোধের জন্য আদেশ প্রদান করতে পারে।
চেক বাউন্সের মামলায় সম্পূর্ণ সাজা ভোগ করলে অর্থ ফেরত দিতে হবে কিনা?
চেক ডিসঅনারের মামলায় আদালত কর্তৃক প্রদত্ত সাজা ভোগ করলেও অর্থদণ্ড বহাল থাকে।
এ ক্ষেত্রে বাদী ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারা অনুযায়ী অর্থদন্ডে উল্লেখিত অর্থ উদ্ধারের জন্য জারির মোকাদ্দমা করতে পারে।
আদালত জারীর মোকাদ্দমায় আসামীর স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ ক্রোক বা বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের জন্য পরোওয়ানা জারী করতে পারে। উক্ত পরোওয়ানা জেলার কালেক্টর বরাবর জারি হলে সেটি দেওয়ানি ডিক্রি হিসেবে গন্য করা হয় এবং কালেক্টর দেওয়ানি কার্যবিধিতে উল্লেখিত নিয়ম অনুসরণ পূর্বক জারী কার্যক্রম পরিচালিত করবে।
আসামীকে গ্রেফতার করে বা আটকাদেশের মাধ্যমে উক্ত জারি কার্যকর করা যাবে না।
জামানত হিসেবে গৃহীত চেক দিয়ে মামলা করা যায় কিনা?
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিকট ঋনের জন্য জামানত হিসেবে চেক জমা প্রদান করা হলে এবং পরবর্তীতে ঋণের অর্থ পরিশোধ না করা হলে ব্যাংক রক্ষিত চেকটি ডিসঅনার করে মামলা দায়ের করতে পারবে। এক্ষেত্রে অর্থঋণ আইনে মামলা হলেও চেকের মামলাটি আইনগতভাবে চলতে পারে।